![]() |
Up Hill Cart Road towards Rongtong - Pic Sumanta Gupta |
দু হাজার উনিশের এপ্রিল মাসে আমি ও আমার বন্ধু রানা সাইকেল চালিয়ে দার্জিলিং গেছিলাম। যে কোনও জায়গায় যাওয়ার আগে আমি রাস্তা নিয়ে প্রচুর রিসার্চ করি। সাইকেল চালিয়ে দার্জিলিং যাওয়ার ওপর তেমন কিছু লেখা চোখে পড়ে নি। নিজের অভিজ্ঞতা ও সাধারণ বুদ্ধি প্রয়োগ করে ঘুরে এসেছিলাম। তাই ফিরে এসে একটা ব্লগ লিখে রাখি (এখানে ক্লিক করে পড়তে পারেন) যাতে অন্যদের ভবিষ্যতে সুবিধে হয়। কিন্তু সেটা ছিল ইংরিজিতে। আজকাল অনেক বাঙালি ছেলে মেয়ে দেখি দার্জিলিং যাবার জন্য ইনফর্মেশন খুঁজছে। তাদের জন্য এটা লিখলাম। একজনও যদি উপকৃত হয় তাহলে আমার প্রচেষ্টা সার্থক হয়েছে মনে করবো।
প্রথমত বলি - আমরা কলকাতা থেকে দার্জিলিং পুরোটা সাইকেলে যাই নি। শিলিগুড়ি থেকে গেছিলাম। আমাদের দুজনেরই ছুটি সীমিত। আমি চাকরি করি। রানা উকিল।তাই কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি তিন চার দিন ধরে সহজ প্লেন রাস্তায় সাইকেল চালানোর কোনো যুক্তি খুঁজে পাইনি। ওটা হাতে সময় থাকলে যে কেউ করতে পারে। ওই রাস্তাটা আমরা তাই বাসে গেছিলাম ও ফিরেছিলাম। কেউ পুরোটা চালিয়ে যেতে চাইলে আমার একদমই কোনও আপত্তি নেই। সহজ সোজা রাস্তা চলে গেলেই হলো। আসল চ্যালেঞ্জ শুরু শিলিগুড়ি থেকে। তাই এই লেখাটা ওই টুকু রাস্তা নিয়েই।
প্রথমে রুট নিয়ে একটু বলি।
শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাওয়ার অনেক গুলো রাস্তা আছে। যারা বাসে বা শেয়ার ট্যাক্সিতে যায় তারা রোহিনী দিয়ে যায়। এটা শুকনা থেকে কার্শিয়াং অবধি অন্য নতুন একটি সোজা রাস্তা। দূরত্ব একটু কম হলেও বেশ খাড়া। সাইকেলে যাওয়ার জন্য সুবিধের রাস্তা নয়। আমার উপদেশ পুরো শিলিগুড়ি থেকে ঘুম অবধি হিল কার্ট রোড দিয়ে যান। তারপর আলুবাড়ি দিয়ে দার্জিলিং। সোজা ম্যালে উঠবেন। তারপর আবার স্টেশন হয়ে হিল কার্ট রোড দিয়ে ফিরবেন। আমরা অন্তত তাই করেছিলাম।
হিল কার্ট রোড এর খাড়াই তুলনামূলক ভাবে অনেক সহজ। তার ওপর এটা একটা ঐতিহ্যবাহী রাস্তা। এই রাস্তার পাশ দিয়েই ঐতিহাসিক টয় ট্রেনের রাস্তা। প্রত্যেকটা স্টেশনে দাঁড়িয়ে একটা ছবি তুলবো এটা আমাদের একটা মজার টার্গেট ছিল প্রথম থেকেই। তাই আমরা ওই রাস্তা দিয়েই গেছি। রাস্তায় অসংখ্য ছোট ছোট জন বসতি। সেখানকার লোকেদের সঙ্গে গল্প করে চা মোমো খেয়ে সাইকেল চালানোর মজাই আলাদা। আমি স্টেশন গুলোর একটা লিস্ট রেলের সাইট থেকে নিয়ে নিয়েছিলাম। তাতে সুবিধে হয় যে পরের স্টেশনটা কত দূরে আন্দাজ পাওয়া যায়। ছোট ছোট গন্তব্য তৈরি করে চালালে মনে সাহস আসে। পুরো ডিস্টেন্সটা একসাথে দেখলে ভয় করে।
![]() |
আমাদের রুট ম্যাপ। শিলিগুড়ি-কার্শিয়াং-ঘুম-দার্জিলিং-মংপু-শিলিগুড়ি |
শুকনা, রংটং ইত্যাদি হয়ে তিনধারিয়ায় লাঞ্চ। কার্সিয়াংয়ে প্রথম দিনের যাত্রা শেষ। পরের দিন টুং আর সোনাদা পেরোলেই ঘুম। ঘুমের আগে অপূর্ব সুন্দর পাইনের জঙ্গল।
আরেকটা রাস্তা দিয়ে যাওয়া যায়। সেটা হলো শিলিগুড়ি থেকে মিরিক হয়ে ঘুম দিয়ে দার্জিলিং। ওটা দিয়েও যেতে পারেন। আমরা যাই নি। হয়ত ভবিষ্যতে যাবো। ওটাও একটু খাড়া, তবে তেমন কিছু বোধ হয় নয়। হিল কার্ট সব চেয়ে সহজ। হিল কার্ট রোডের একটাই সমস্যা। রাস্তায় পাগলা ঝোরা বলে একটা ঝর্ণা পড়ে। ওটা অনেক সময় বর্ষা কালে ধস নেবে বন্ধ হয়ে যায়। বর্ষার আগে গেছিলাম বলে আমাদের সেটা নিয়ে ভাবতে হয় নি। আপনারা যদি বর্ষার পরে যান, তাহলে পাগলা ঝোরা সম্বন্ধে খোঁজ নিয়ে যাবেন।
![]() |
The journey starts from here. Just outside Siliguri |
আপনি যত বড়োই সাইক্লিস্ট হন না কেন প্রথম দিন শিলিগুড়ি থেকে কার্শিয়াং অবধি যাবেন। তার পরের দিন দার্জিলিং। একদিনে পুরোটা যাওয়া অসম্ভব। আমরা দ্বিতীয় দিন ঘুমে থেকে গেছিলাম। ঘুম থেকে দার্জিলিং অল্প একটু ঢালু পথ। গেলেই হলো। প্যাডেল না করেই চলে যাওয়া যায় প্রায়। আমি আসলে এত অসংখ্য বার দার্জিলিং গেছি যে আমরা ঠিক করলাম ঘুমেই থাকবো সেদিন। ওখানে একটা হোম স্টে পেয়ে গেলাম তাই থেকে গেলাম। পরের দিন জাস্ট ছবি তোলার জন্য সকালে দার্জিলিং গেলাম ও আবার দুপুরের মধ্যে ফিরে এলাম ঘুমেই। আপনারা যদি দার্জিলিঙে থাকতে চান নিশ্চই যাবেন পুরোটা। আমার ঘিঞ্জি দার্জিলিঙে থাকতে আজকাল আর ভালো লাগে না।
এবার আসি নিজের শারীরিক প্রস্তুতি, সাইকেল ও কি কি নেবেন সে সম্বন্ধে কিছু কথায়।
শিলিগুড়ির একটু পর শুকনা থেকে ঘুম অবধি কিন্তু টানা খাড়া রাস্তা। পাহাড় শুরু হয় শুকনা স্টেশন থেকে। তারপর এক মুহূর্তের জন্য ফ্ল্যাট বা ঢালু পথ পাবেন না। শরীর অবশ্যই চূড়ান্ত ফিট হতে হবে। তবে প্র্যাকটিস করলে সবই সম্ভব। আমি নিজে রোগা পাতলা লোক। যখন গেছিলাম তখন বয়স পঞ্চান্ন প্রায়। কাজেই সবার পক্ষেই সম্ভব। তবে পাহাড় কে হেলাফেলা করবেন না। শারীরিক প্রস্তুতি নিয়ে যাবেন।
![]() |
রাস্তার ধারে একটু বিশ্রাম। অনেক পথ বাকি। |
আমার সাইকেল টার পেছনে দশ ও সামনে তিনটে গীয়ার আছে। আমি একদম ফার্স্ট গীয়ারে চালিয়েছি। বয়স হয়ে গেছে আগেই বলেছি। আপনার শারীরিক ক্ষমতা অনুযায়ী আপনি ঠিক করবেন আদৌ গীয়ার ওয়ালা সাইকেল আপনার লাগবে কিনা। তবে যাবার আগে যেমন ওঠা নিয়েই আমাদের সমস্ত চিন্তা ছিল গিয়ে বুঝলাম যে পাহাড়ে ওঠার থেকে নাবা অনেক অনেক কঠিন। আমরা ঘুম থেকে সেঞ্চাল ফরেস্ট দিয়ে মংপু হয়ে ফিরে ছিলাম। সাংঘাতিক খাড়া ও সরু রাস্তা। ব্রেক করে করে আস্তে আস্তে নাবা। বেশী ব্রেক করলে রিম গরম হয়ে যাচ্ছে। টিউব ফেটে যাওয়ার আশু সম্ভবনা। তাই মাঝে মাঝেই দাঁড়িয়ে রিম ঠান্ডা করে আবার নাবা। এতে সময়ও লাগে বেশী আর ঝুঁকি তো আছেই। এই ধরণের রাস্তায় নাবতে গেলে ব্রেক যেন ১০০ শতাংশ ভালো থাকে। পারলে ব্রেক টাইট করা একটু শিখে নেবেন। ওই রাস্তায় ব্রেক না লাগলে কিন্তু হেঁটে নাবতে হবে।
সাইকেলের ব্রেকের পর আরেকটা যেটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ জিনিস মাথায় রাখতে হবে সেটা হলো - দার্জিলিঙের রাস্তায় সাংঘাতিক কুয়াশা হয়। দিব্যি ঝক ঝকে রোদ দেখে বেরোলেন। একটু পরেই ঘন কুয়াশায় সামনের চাকা পর্যন্ত্য দেখা যাচ্ছে না এরকম হয়ে যেতে পারে। এখানে দুটো জিনিস অত্যন্ত জরুরি। এক আপনার সামনে পেছনে যেন আলো থাকে। সেটা জ্বেলে নেবেন। আর পারলে হাই ভিসিবিলিটি জ্যাকেট পরে থাকবেন। ময়দান মার্কেটে খুবই সস্তায় পাওয়া যায়। যেটা মাথায় রাখতে হবে - গাড়ির ড্রাইভার যেন আপনাকে দেখতে পায়। এই প্রসঙ্গে এটাও বলে রাখি - সঙ্গে অবশ্যই একটা রেনকোট নেবেন ও হাতের কাছে রাখবেন। যে কোনও মুহূর্তে যে কোনও সিজনে বৃষ্টি আসতেই পারে। জিনিস পত্র যা নেবেন সেই ব্যাগ হয় ওয়াটার প্রুফ হতে হবে অথবা প্লাস্টিক জড়িয়ে নেবেন। নাহলে গন্তব্যে পৌঁছে দেখবেন সমস্ত জামা কাপড় ভিজে গেছে।
![]() |
স্বপ্ন পূরণের মুহূর্ত। দার্জিলিং ম্যালে রানা আর আমি। সঙ্গে আমাদের প্রিয় সাইকেল। |
এবার আসি কি কি নেওয়া উচিৎ সেই বিষয়ে।
প্রধানতঃ দু ধরনের জিনিস নিয়েছিলাম। এক হলো সাইকেল সারানোর বেসিক সরঞ্জাম। দুই নিজেদের জামাকাপড় ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র। একটাই কথা মাথায় রাখবেন - এক গ্রামও এক্সট্রা ওজন নেবেন না। চড়াই রাস্তায় ওঠার সময় মনে হচ্ছিল টুথ ব্রাশটাও ফেলে দিই। যারা কোনও দিন পাড়ার বাইরে সাইকেল নিয়ে বেরোয় নি তারা প্রচুর জ্ঞান দেবে এটা নে ওটা নে বলে। শুনবেন না। বইতে হবে আপনাকে।
সাইকেলের জন্য শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং আমি যে জিনিস গুলো নিয়েছিলাম সেগুলো হলো এই রকম
সত্যি বলতে কি এর কিছুই লাগে নি। আমাদের যাত্রা ঈশ্বরের আশীর্বাদে নির্ঝঞ্ঝাট হয়ে ছিল। কিন্তু কিছু হলে মোটামুটি প্রস্তুত ছিলাম। হাওয়া ভরার পাম্প রানা নিয়েছিল। গ্রুপে গেলে ভাগাভাগি করে এগুলো নেওয়া যায়।
আমি সাইকেল চালানোর সময় এই জিনিস গুলো পরে ছিলাম বা শরীরে ছিল
Half-sleeve cycling jersey
Cycling bib
Socks
Cycling gloves
Cycling helmet
Trekking boots
Turkish small hand towel
সঙ্গে এই জিনিস গুলো নিয়ে ছিলাম।
![]() |
ঘুম থেকে আলুবাড়ি হয়ে দার্জিলিং। অপূর্ব সুন্দর রাস্তা। |
No comments:
Post a Comment